স্বদেশ ডেস্ক:
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ ৬ই অগাস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে দেশটির সরকার। এই সময়ে সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে এই বন্ধের কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা (এইচএসসি) নিয়ে অনিশ্চয়তাও বাড়ল।
সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে সেপ্টেম্বর নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় কবে নাগাদ এই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করতে পারবেন, তাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে একটি বছর হারিয়ে যাবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
একদিকে সরকার যেমন এখনো এইচএসসি পরীক্ষার কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারছেন না, তেমনি পাবলিক-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিস্থিতির উন্নতি আর সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন টানা বন্ধের ঘটনা আর ঘটেনি।
অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীরা
ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা নাফিস শাহরিয়ারের এই বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তার সব পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেছে।
“ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টার পাশাপাশি বিদেশে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করবো। কিন্তু পরীক্ষা হবে না জানার পর থেকে পড়াশোনা আর ঠিকভাবে করা হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে একটা চিন্তার মধ্যে আছি।”
ফরিদপুরের একজন পরীক্ষার্থী তানিয়া ইয়াসমিন বলছেন, “যেভাবে প্রিপারেশন নিয়েছিলাম, তাতে বড় একটা ছেদ পড়লো। লকডাউন শুরুর পর থেকে তো কোচিং, স্যারদের কাছে পড়া সব বন্ধ। যা পড়েছিলাম, তাও এখন ভুলতে বসেছি। নতুন একটি ডেট দিলে আবার জোরেশোরে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।”
বাংলাদেশে ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এইচএসসি) মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লক্ষের বেশি।
এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এপ্রিল মাসের শুরুতে। কিন্তু করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতির কারণে তখন সাধারণ ছুটি ও সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেই পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। এরপরে কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি বাড়ানোয় পরীক্ষা আয়োজন সম্ভব হয়নি।
কবে হবে এইচএসসি পরীক্ষা
দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি শেষ হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ৬ই অগাস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের সরকার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন টানা বন্ধের ঘটনা আর ঘটেনি।
কর্মকর্তারা বলছেন, সব কিছু নির্ভর করছে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কি হয়, তার ওপরে।
বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থীদের বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাটা হলো পরিস্থিতির যখন উন্নতি হবে, স্বাভাবিকের দিকে আসবে, তখন আমর তারিখটা ঘোষণা করবো। তখন পরীক্ষাটা নেবো।”
অগাস্টের পর পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করলে, পরীক্ষা অনুষ্ঠান, ফলাফল প্রকাশ হতে হতে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস লেগে যেতে পারে। তার কিছুদিন পরে আরেকটি এইচএসসি পরীক্ষার সময় চলে আসবে। সেক্ষেত্রে কী করা হবে, জানতে চাইলে তিনি বলছেন, এখনি তারা এ বিষয়ে আগাম বলতে চান না।
“আমরা কিছু কন্টিনজেন্সি প্লান (সম্ভাব্য সব ঘটনার জন্য বিকল্প পরিকল্পনা) করে রেখেছি। পরীক্ষা কোন সময়ে নেবো, তার সঙ্গে ম্যাচ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে। পরিস্থিতি দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।”, বলছেন মি. হোসেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আপাতত সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে তখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কতোটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়, তার ওপরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পেছাতে হবে
বাংলাদেশে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সেশনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। কিন্তু এই বছর সেটা কবে হবে, তা কারো জানা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “সব কিছুই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এটাই বাস্তবতা। শুধু ভর্তি নয়, আমাদের গ্রাজুয়েশন কার্যক্রমও প্রলম্বিত হবে। ভর্তি কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত এর মধ্যেই আমরা নিয়ে রেখেছি। এখন আমরা অপেক্ষা করছি পরিস্থিতি দেখার জন্য যে, অগাস্ট সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি কেমন হয়।”
তিনি বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হলে সেই অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এই জটিলতা একটু কম। তারা বছরে তিনটি সেমিস্টারে ছাত্র ভর্তি করে থাকে। ফলে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর তারা যেকোনো সময়েই ভর্তি করতে পারবে। তবে এই সময়সূচীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভর্তি সময় বদলে নিতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক এম. শাহজাহান মিনা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সাধারণত এইচএসসি পরীক্ষার পরে সেপ্টেম্বর সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি বেশি হয়। এখন পরীক্ষা সেপ্টেম্বরে হলে তাদের ফলাফল পেতে নভেম্বর-ডিসেম্বর হয়ে যাবে। ফলে জানুয়ারির আগে তাদের ভর্তি করানো সম্ভব হবে না। এর ফলে প্রতিটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত দুইটা সেপ্টেম্বরে ভর্তি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেশনজটের তৈরি হতে পারে?
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক এম. শাহজাহান মিনা বলছেন, সেটার সম্ভাবনা কম।
“বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো সেমিস্টারেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যেমন একবছরের একটা গ্যাপ থাকতো। এখন হয়তো সেই গ্যাপটা একবছর থাকবে না, সেটা হয়তো আটমাসে নেমে আসবে।”
তিনি মনে করেন, যেহেতু ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে সামনে বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও এপ্রিল-মে মাসের বদলে দুই-একমাস পিছিয়ে যেতে পারে।
বিকল্প ভাবতে হবে
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন বা ক্যাম্পে। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়েছে। বাংলাদেশে যদি এইচএসসির মতো বড় পরীক্ষা আয়োজনে সমস্যা হয় বা পিছিয়ে দিতে হয়, তাহলে সেটার বিকল্প এখনি ভাবা উচিত।
তিনি বলছেন, “শিক্ষাপঞ্জি যে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে পরীক্ষা নির্ভর, সে কারণে এটা আরেকটি সমস্যা তৈরি করেছে। কারণ এখানে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে শিক্ষাপঞ্জি অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার মানে হলো শিক্ষার্থীদের সব ধরণের কর্মকাণ্ডই অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া।”
“এইচএসসি একটা বড় পরীক্ষা। সেটা পিছিয়ে গেলে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। বিকল্প কী হতে পারে, পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে কী করবেন, সেটা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সমাধান বের করতে হবে। অনেক দেশে আগের ক্লাস পরীক্ষার মার্কিং বা গ্রেডের ফলাফলের ভিত্তিকে এভারেজ রেজাল্ট ঠিক করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটাও একটা বিকল্প ভাবা যেতে পারে।, বলছেন রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি জানান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিক্ষা ব্যাহত হওয়ায় অটো প্রমোশন হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয়েছিলেন, তারা একটা সেশন জটে পড়লেও, পরবর্তী এক-দুই বছরের মধ্যে সেটার সমাধান হয়েছিল। সূত্র : বিবিসি